পটভূমি

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশের আপামর জনগণ রাজপথে নেমে এসেছিল শেখ হাসিনার দুঃশাসন থেকে মুক্তির আশায়।

২০২৪ সালের ১ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই রূপ নেয় এক পূর্ণাঙ্গ গণঅভ্যুত্থানে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘লাল বিপ্লব’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রথমে ছিল সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে আওয়াজ, কিন্তু সরকারের দমনপীড়ন, ছাত্রলীগের সহিংসতা এবং প্রধানমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত করে তোলে। ১ থেকে ১৪ জুলাই শাহবাগে বিক্ষোভে উত্তাল হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো, ১৫–১৮ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ মৃত্যুর পর আন্দোলন সহিংস মোড় নেয় এবং দেশজুড়ে কারফিউ ও সেনা মোতায়েন শুরু হয়। ১৯ জুলাই ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঢাকাকে কার্যত অচল করে তোলে; রাতে ইন্টারনেট বন্ধ ও আন্দোলনকারীদের তুলে নেওয়া শুরু হয়। ২০–২৬ জুলাই দেশজুড়ে ব্লক রেইড, হাজারো গ্রেপ্তার ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ চালিয়েও আন্দোলন দমন করা যায়নি। ২৭–৩১ জুলাই নেতাদের ভিডিও বার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, বরং জনতা আরও শক্তিশালী হয়ে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ ও ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করে। ১–৪ আগস্ট চলা অসহযোগ আন্দোলনে ১৮ জেলায় সংঘর্ষে শতাধিক প্রাণহানি ঘটে, লাখো মানুষ ঢাকায় সমবেত হয়, আর প্রশাসনের একটি বড় অংশ নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন এবং সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বিভাজনের দায় কার?

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক লাল বিপ্লব বা জুলাই আন্দোলনের অন্যতম শক্তি ছিল এর বৈচিত্র্যময়, মত-পথ অতিক্রমী ঐক্য। এই ঐক্যে লিবারেল, প্রগতিশীল, ধার্মিক, ধর্মনিরপেক্ষ, শহর-গ্রাম, গরিব-ধনী—সব শ্রেণি ও চিন্তার মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু আন্দোলনের বিজয়ের পর পরই একটি শ্রেণি (উগ্র ইসলামপন্থীরা) এই ঐক্যকে কাঠামোগতভাবে ভাঙতে শুরু করে।

সমকামী ও ট্রান্সজেন্ডারদের “জাতীয় ঐক্য” থেকে বের করে দেয়া

প্রথমে মাইনাস করা হয় সমকামীদের প্রতিনিধি ও সাহসী কণ্ঠস্বর অ্যাডভোকেট মানজুর আল মতিনকে। তিনি ছিলেন একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী যিনি আন্দোলনের সময় রাজপথে ও আদালতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ান এবং দেশজুড়ে প্রশংসিত হন। কিন্তু তিনি সমকামীদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এই অজুহাতে মৌলবাদীরা তাকে বিপ্লব-পরবর্তী সময়েই অপদস্থ করে এবং ‘জাতীয় ঐক্য’-র বাইরে ঠেলে দেয়।

এই একই ধারা দেখা গেছে সমন্বয়ক মুনতাসীর মুনের ক্ষেত্রেও। যিনি বিপ্লবের সময় মূল নেতাদের নিরাপদে একটি দূতাবাসে লুকিয়ে রাখেন, যখন পুলিশ তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পরবর্তীতে তাকে একটি রাজনৈতিক দলে পদ দেওয়া হলেও, তার সমকামীদের প্রতি সহানুভূতির কারণে দল থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়।

নাস্তিকদের “জাতীয় ঐক্য” থেকে বের করে দেয়া

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনায় উৎসব মণ্ডল নামের এক হিন্দু কিশোরকে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে আটক করে গণপিটুনি দেওয়া হয়, যা ঘটে সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপস্থিতিতেই। উত্তেজিত মাদ্রাসা ছাত্র ও ইমামদের নেতৃত্বে ‘প্রচলিত আইন নয়, ওদের আইনেই বিচার চাই’ দাবি উঠে এবং শিশুটিকে মারধর করা হয় এমনভাবে যে, তাকে মৃত ভেবে পলিথিনে মুড়ে নিয়ে যেতে হয়। পরে জানা যায়, সে বেঁচে আছে। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আজও একটি হিংস্র গণবিচারের অস্ত্র, যেখানে বিচার নয়, পরিচয়ই অপরাধে পরিণত হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন পাশ দাঁড়িয়ে থাকে, তখন প্রগতিশীলতা নয়, মৌলবাদই সমাজের শাসক হয়ে ওঠে। এরকম আরও কিছু ঘটনা এরা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ইসলামপন্থী লেখক রাখাল রাহার ফাঁসির দাবী থেকে শুরু করে অন্যান্য ইসলামপন্থী লেখককেও কতলের দাবী তোলা হয়। নাস্তিক লেখকদের অবস্থা এ থেকে সহজেই অনুমেয়।

২০২৫ সালের এপ্রিলে প্রথম আলো পত্রিকার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে একটি মামলার আবেদন করা হয়, কারণ তারা ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত একটি কার্টুনে কুকুরের ছবি ব্যবহার করেছিল। যদিও কার্টুনটি সরাসরি ইসলাম বা ঈদকে অবমাননার উদ্দেশ্যে নয়, বরং সমাজের নির্দিষ্ট মনোভাব ব্যঙ্গ করেছিল, তবুও উগ্র ইসলামপন্থীরা এটিকে ধর্ম অবমাননার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে মামলা চায়। এসব ঘটনা প্রকাশ্যে এনে দেয়, কীভাবে নাস্তিকতাবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শকে দমন করতে ছলচাতুরী ও মনঃপূত ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয় মৌলবাদী গোষ্ঠী, সাংবাদিকতা, ব্যঙ্গ বা স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সরাসরি বিপন্ন করে তোলে।

নারীদের “জাতীয় ঐক্য” থেকে বের করে দেয়া

জুলাই বিপ্লবের সময় নারীরা ছিলেন আন্দোলনের সম্মুখভাগে। পোস্টার হাতে, ব্যানারে, শহীদ মিনারে, এবং নেতৃত্বে। কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, এক উগ্র ও পুরুষতান্ত্রিক গোষ্ঠী সুপরিকল্পিতভাবে নারীদের জনপরিসর থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। “মাথায় কাপড় নেই কেন”, “ওড়না পরে না কেন”, “পেট দেখা যাচ্ছে”— এই সব অজুহাতে নারী সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, কর্মজীবী এমনকি পথচারী নারীকেও প্রকাশ্যে অপমান ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। আন্দোলনকালীন নারী নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে, নারীর পোশাক, শরীর ও ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর ‘নৈতিকতা’ চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। চিত্রশিল্পী থেকে শুরু করে যৌনকর্মী পর্যন্ত, কেউই বাদ পড়ছে না। এটি নিছক অসামাজিক আচরণ নয়। এটি ঐক্যের রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

এই সহিংস বাস্তবতায়, মাদার কেয়ারের সামনে শায়লা বিথীর ওপর হামলা বা সাংবাদিক ঝর্ণা রায়ের হেনস্তা কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং নারী নেতৃত্বের প্রতি একটি বার্তা—”তোমাদের ঠাঁই নেই নতুন সমাজকাঠামোতে যদি তোমরা আমাদের পোশাকবিধি না মানো।” অতীতের আন্দোলন ও প্রতিবাদের সময় যারা ছিলেন নারী অধিকারের কণ্ঠস্বর, তাদেরও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়, রাস্তায়, এমনকি নিজ গাড়ির ভেতরও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। নেতৃত্বে থাকা নারী ব্যক্তিত্বরা যেমন অপরাজিতা সংগীতা, তিনিও রেহাই পাচ্ছেন না। এই প্রবণতা যদি প্রতিহত না করা হয়, তাহলে নারী নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণহীন একটি ‘স্বাধীনতা’ গড়ে উঠবে—যা বাস্তবে আরেক ধরনের নিপীড়ন ব্যবস্থার জন্ম দেবে। তাই এ মুহূর্তে দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিরোধ, যেখানে নারীকে ঐক্যের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা হবে, দর্শক নয়—নির্ধারক হিসেবে।

হিন্দুদের “জাতীয় ঐক্য” থেকে বের করে দেয়া

৫ আগস্ট ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর সহিংসতা, মন্দির ভাঙচুর, গ্রামে গ্রামে হামলা, জোরপূর্বক জমি দখলের মতো ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই হামলাগুলোকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে এবং তাদের পক্ষ থেকে কোনো জরুরি তদন্ত কমিটি বা হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং এটি গুজব বলে চালিয়ে দেওয়ার মতো মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই নীরবতা এবং অস্বীকার সংস্কৃতির প্রতিবাদেই শুরু হয় হিন্দু নাগরিকদের এক বিপুল গণআন্দোলন।

১২ আগস্ট শাহবাগ মোড় অবরোধ করে এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চ’, ‘সনাতন ছাত্র ও নাগরিক সমাজ’সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হিন্দু ও ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনগুলো এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। আট দফা দাবির মধ্যে ছিল দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হামলার বিচার, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও মন্ত্রণালয়, হিন্দু ফাউন্ডেশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ, দুর্গাপূজায় পাঁচদিন ছুটি এবং পুনর্বাসন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা কেবল নির্যাতনের বিচার নয়, বরং সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সাংবিধানিক ও কাঠামোগত স্বীকৃতির আওতায় আনার দাবি তোলে। শাহবাগ অবরোধ তাই নিছক একটি প্রতিবাদ নয়, এটি ছিল রাষ্ট্রীয় অস্বীকৃতির বিপরীতে একটি আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

এই ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট হয়: ঐক্যের কাঠামো ভেঙেছে মৌলবাদীরা। যারা বিজয়ের পর রুচি-পছন্দ, বিশ্বাস ও পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষকে বাদ দিতে শুরু করেছে, তারাই ঐক্যের প্রধান হন্তারক। একটি আদর্শিক বিপ্লবকে তারা সামাজিক পিউরিটানিজমের নামে হাইজ্যাক করতে চেয়েছে। অথচ আন্দোলনের সময় কেউ বলেনি, “এখানে মোল্লা কেন?” কিন্তু আন্দোলন জেতার পর মোল্লারা জিজ্ঞেস করেছে, “এখানে সমকামী কেন?”, “এখানে নাস্তিক কেন?”, “এখানে নারী কেন?”, এমনকি “এখানে হিন্দু কেন?”

এই ইতিহাস ভুললে চলবে না। জয় সবার, অথচ বিজয়ের পর নিজের মতাদর্শের লোক বাদে আর সবাইকে ‘মাইনাস’ করার রীতি চালু করলে, সেটি আর বিপ্লব থাকে না, হয়ে ওঠে নতুন নিপীড়ন।

জেনারেল লাইন বনাম মাদ্রাসার ছাত্রদের ভূমিকা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন নিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর দাবি হলো, এতে নাকি “৯৫% আন্দোলনকারী মাদ্রাসার ছাত্র” ছিল, যা বাস্তবতা ও ঘটনাপ্রবাহের সম্পূর্ণ বিপরীত। আন্দোলনের শুরু থেকে অন্তত ২৬ জুলাই পর্যন্ত, মাদ্রাসার ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল ন্যূনতম; আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা। অনেক মাদ্রাসাপন্থী তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যেই দাবি করেছিল যে ‘সাধারণ জেনারেল লাইনের ছেলেমেয়েরাই ঈমানের ধারক-বাহক’, কারণ তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায়।

এমনকি হুজুর বা আলেম সমাজও এই সময় প্রায় পুরোপুরি নীরব ছিল, যা জনগণের মধ্যেই প্রশ্ন তুলেছিল, “হুজুররা কোথায়?” এই প্রশ্নের জবাবে পরবর্তীতে চিকা মারা হয়েছিল “হুজুররা আয়নাঘরে”। এই দাবীটি সঠিক নয়, কারণ মৌলবাদীদের বড় একটা অংশই জেলখানা বা আয়নাঘরের বাইরে ছিলেন। অর্থাৎ তাদের হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহসে কুলোয়নি, নয় তারা শেখ হাসিনার থেকে এমন কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিলেন যে কারণে তারা এই সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চাননি। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে (যেমন ছাত্রলীগ বিতাড়নের পর, ব্ল্যাকআউট চলাকালে, বা সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশগ্রহণের সময়ে) বারবার দেখা গেছে মূল নেতৃত্ব ও সম্মুখসারির আন্দোলনকারীরা ছিলেন জেনারেল শিক্ষাব্যবস্থার তরুণরা। যাত্রাবাড়ি এবং কিছু বিচ্ছিন্ন উদাহরণ বাদে মাদ্রাসার ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ দেখা যায় কেবল দোসরা বা তেসরা আগস্টের পরে, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবী ওঠার পরবর্তী সময়ে, যখন আন্দোলনের ফলাফল নিশ্চিত হতে শুরু করে। অতএব, ইতিহাসকে বিকৃত করে আন্দোলনের অবদান বা মালিকানা দাবি করা যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনি অন্য কাউকে অবদানের বাইরে ঠেলে দেওয়াও অন্যায়। আন্দোলনের ক্রেডিট প্রত্যেকে পাবে তার ভূমিকার অনুপাতে। না তার বেশি, না কম।

শেখ হাসিনার দালালদের কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর

নির্লজ্জ প্রশ্ন ০১ | জুলাই বিপ্লব একটি ষড়যন্ত্র ছিল। যারা এতে জেনেশুনে গেছে তারা দেশের ক্ষতি জেনেশুনে করেছে।

‘আগে বাংলাদেশি’-র অবস্থান : জুলাই বিপ্লবকে ষড়যন্ত্র বলা কেবল অজ্ঞতা নয়—এটি সরাসরি দেশদ্রোহিতা। যারা জেনে, বুঝে, সজ্ঞানে শেখ হাসিনার দালালি করে, তারাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। আওয়ামী লীগ একের পর এক কার্যক্রম দিয়ে গণতন্ত্র হত্যা করেছে, জঙ্গিবাদকে তলে তলে বাড়তে দিয়েছে, তারপর উপর থেকে একটা ঢাকনি চাপিয়ে সব ভুলে যাওয়ার ভান করেছে আর এই কাজগুলো করেছে পুরোপুরি সচেতনভাবে।

দেশের সত্যিকারের দেশপ্রেমিকরা জানে, প্রগ্রেস কোনোদিন দেশের ক্ষতি হতে পারে না। আমরা যারা প্রগতিশীল, তারা চাই গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান। মৌলবাদ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তাকে সরাসরি মোকাবেলা করতে হয়। তা দিয়ে রাজনীতি করতে হয় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকার পরও মৌলবাদ মোকাবেলা না করে তা জিইয়ে রেখেছে যেন তারা ‘সেভিয়র’ হতে পারে এবং মৌলবাদ দমন করার নাম করে নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় থাকতে পারে। মৌলবাদরা দেশের ক্ষতি করেছে, করবে। জুলাইয়ের আগেও করেছে, শেখ হাসিনার সরকার বিশেষ গা করেনি। মৌলবাদীদের করা ক্ষতির দায় আমাদের নয়, বরং এই দায় (১) মৌলবাদীদের, (২) মৌলবাদী চিহ্নিত করার পরও সকল ক্ষমতা থাকা সত্বেও যারা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য সেটি নিশ্চিহ্ন করেনি, তাদের। প্রোগ্রেসিভ প্রতিটা মানুষ জানতো ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশে মৌলবাদের উত্থান ঘটবে। দেশপ্রেমিক নাগরিকরা মৌলবাদ নিয়ে রাজনীতি করে না, কাজেই তারা এই সমস্যাটিকে নগ্নভাবে মোকাবেলা করতে চায়। আওয়ামী লীগের দালালরা এর মোকাবেলা চায় না। তারা চায় দুটো জঙ্গি হত্যা করে আর দশ হাজার জিইয়ে রেখে আজীবন ক্ষমতার নিশ্চয়তা। এর ক্ষতিকর দিক হলো, আওয়ামী লীগ আসল জঙ্গি পাঁচজন অ্যারেস্ট করলে, দশজনকে অ্যারেস্ট করেছে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে, স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের লক্ষ্যে। জুলাই-আগস্টের পাইকারি হত্যার পর তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার প্রশ্নে লিবারেল ও প্রোগ্রেসিভ সমাজ এজন্য আওয়ামী লীগকে কোন ছাড় দেয়নি। ‘আগে বাংলাদেশি’ মৌলবাদ নিয়ে রাজনীতি করবে না। বিনা প্রশ্নে এবং বিনা স্বার্থে মৌলবাদ ধ্বংস করবে। ভোট চাওয়ার সময় ‘আগে বাংলাদেশি’ কখনো জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ দমনের কথা বলবে না। কারণ এটা ‘বাই ডিফল্ট’ করার কথা যে কোন সরকারের। ভোট চাওয়ার জন্য এসব ব্যবহার করার অর্থ একটি পবিত্র দায়িত্ব আপনি ব্যবসার কাতারে তুলেছেন।

নির্লজ্জ প্রশ্ন ০২ | সব জেনে বুঝে কেন আন্দোলন করলেন?

২০২৪ সালের গণআন্দোলনের প্রাথমিক চালিকা শক্তি ছিল সরাসরি হত্যার প্রতিবাদ। আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য জনসাধারণের আবেগে গভীরভাবে নাড়া দেয়। কিন্তু এই আন্দোলনে নামা জনস্রোত ছিল না ইসলাম কায়েম বা গণতন্ত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে সংগঠিত; বরং এটি ছিল একটি মুহূর্তের মানবিক প্রতিবাদ। বেশিরভাগ মানুষ গণতন্ত্রের কাঠামোগত ধারণা কিংবা রাষ্ট্রধর্মের অসাংবিধানিকতা সম্পর্কেও অবগত নয়।

অন্যদিকে, শিক্ষিত সমাজ জানে এমন হত্যার পুনরাবৃত্তি থামাতে একমাত্র পথ গণতান্ত্রিক কাঠামো। তারা বোঝে, একনায়কতন্ত্র রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বৈধতা দেয়, যেখানে বিরোধিতা করাও ‘পবিত্রতা লঙ্ঘন’ বলে বিবেচিত হয়। গণতন্ত্রই একমাত্র ব্যবস্থা যেখানে নাগরিক রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে পারে, সরকারকে লাথি মেরে নামাতে পারে। সে কারণেই শিক্ষিতরা এই আন্দোলনকে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের লড়াই হিসেবে দেখেছে ও যুক্ত হয়েছে।

ইসলামিস্টরা জুলাই নয়, ২০০৮ সাল থেকেই চায় আওয়ামী লীগ পড়ে যাবে। কাজেই ২০২৪ এ যখন হাসিনার সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেল, সবার আগে ইসলামিস্টরা আন্দোলনে আসা শুরু করলো (আগেই বলা হয়েছে তারা এর আগে গর্তে লুকিয়ে ছিল)। এটা যে হবে তা শিক্ষিত সমাজ অবশ্যই জানতেন। তারা এটাও জানতেন ভবিষ্যতে এই সমস্যা ডিল করতে হবে। ওই মুহূর্তে হাজারো জনগণকে হত্যা করে ফেলা একটি সরকাররের পতন ঘটানো জরুরী ছিল।

শিক্ষিত সমাজ জানেন আওয়ামী লীগের মতো সিস্টেমেটিক মনস্টার যদি ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে মৌলবাদের মতো বিশৃঙ্খল দানবও ফেলা সম্ভব হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য প্রগ্রেস এবং অগ্রযাত্রা। শিক্ষিত সমাজের জুলাইয়ের আন্দোলনে সহাবস্থানকে ‘আগে বাংলাদেশি’ সমর্থন করে, কারণ সবার আগে একজন বাংলাদেশিকে রেখেই এই আন্দোলনে তারা নেমেছিলেন। এটা দলীয় মূলনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।

মৌলিক নৈতিক অবস্থান | জুলাইবিরোধিরা ‘আগে বাংলাদেশি’র চোখে দেশদ্রোহী

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রতিদিন রাজপথে নিরস্ত্র ছাত্র ও সাধারণ জনতাকে গুলি করে হত্যা করছিল। অথচ সেই সময়েও অনেক মানুষ আন্দোলনে যোগ না দিয়ে ফেসবুকে শুধু লিখে যাচ্ছিলেন, “এতদিন যা চাইছিলেন তার পক্ষে ছিলাম, এখন যা চাইছেন তার পক্ষে নেই”। এই বলে তারা ‘এক দফা এক দাবী: হাসিনার পতন’ স্লোগান থেকে নিজেকে আলাদা রাখছিলেন। ফলে ‘আগে বাংলাদেশি’ ঘরানার মানুষের চোখে এই নির্লিপ্ত শ্রেণিই প্রকৃত দেশদ্রোহী কারণ তারা খুন দেখেছেন, তবু প্রতিবাদ করেননি। তারা “ব্যক্তি মরে গেলে যাক, তবুও আওয়ামী আদর্শ যেন ক্ষমতায় থাকে” চিন্তায় চলে গেছেন। অথচ ‘আগে বাংলাদেশি’র রাজনীতি প্রতিটি ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার রাজনীতি। যে কোন আদর্শ এবং নীতি থেকে উর্ধ্বে ব্যক্তি। ব্যক্তির অধিকার রক্ষা না করে যারা তখন সরকারের দালালী করেছেন তাদের প্রত্যেকে জঘন্য অপরাধ করেছেন বলে ‘আগে বাংলাদেশি’ মনে করে। কারণ, কোন দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তরফ থেকে নিরস্ত্র, নিরীহ, নির্দলীয় জনগণ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের উদ্দেশ্যে গুলি করার কোন জাস্টিফিকেশন ‘দেশ জঙ্গির হাতে চলে যাবে’ হতে পারে না।

সারসত্য

একাত্তর, নব্বই, চব্বিশ – এই তিন নিঃশর্তে ধারণ করতে না পারলে আপনি ‘আগে বাংলাদেশি’র সদস্য হতে পারবেন না। এই দলটি যে কোন গণঅভ্যুত্থানকে সমর্থন করে এবং মনে করে সকল লিঙ্গ-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন রাজপথে নেমে এসে কিছু একটা বলে, তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়াই গণতান্ত্রিক পথ। যারা এই তিনের কোনটিকেই অস্বীকার করেন, তারা মূলতঃ গণতন্ত্র চান না, অথবা গণতন্ত্রের ধারণাটাই তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তারা যেটিকে গণতন্ত্র মনে করেন তা কোন গণতন্ত্র নয়। যেহেতু রাজনৈতিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মানুষকে শিক্ষাদান করা, এই সংজ্ঞা শেখানোর দায়িত্বও ‘আগে বাংলাদেশি’ নিঃসন্দেহে সঠিকভাবে পালন করবে।

(আর্টিকেলটি চলমান। এতে আরও কিছু দালালের প্রশ্নের জবাব যুক্ত হবে এবং জুলাই-আগস্ট নিয়ে যেসব জ্বলন্ত প্রশ্ন যুক্ত হয়েছে তাদের জন্য আলাদা আলাদা অধ্যায় যুক্ত হতে থাকবে।)

 

তথ্যসূত্র

  1. https://prothomalo.com/bangladesh/djyw3hz2ak
  2. https://www.prothomalo.com/bangladesh/smyvuediet
  3. https://www.dw.com/bn/%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%97-%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF/a-70146163
  4. https://www.bbc.com/bengali/articles/c7v5g5rr05vo

 

#

No responses yet

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Page Views
3717

JOIN US!

Join Us!